Monday 25 April 2016

কবিতা

লেখাপড়া

আলী আহমদ চৌধুরী

লেখাপড়া ভাল লাগেনা
পড়ায় বসেনা মনে,
ছাত্র হয়ে ভুল করেছি
শুধুই জ্বালাতন।
কৃষক যদি হতাম আমি
নিয়ে যেতাম হাল মাঠে,
চাষ করিতাম মনের মত
ফসল ফলিত তাতে।
হতাম যদি রাখাল আমি
চরাতাম অনেক গরু,
সবুজ শ্যামল মাঠ দেখিতাম
আরও দেখিতাম তরু।
মাঝি হলে গান ধরিতাম
নাও নিয়ে নদীর মাঝে,
সারা বেলা গান করিতাম
ফিরিতাম সন্ধ্যা সাঝে।
জেলে হলে মৎস ধরিতাম
বেচিতাম গঞ্জের হাটে
মায়ের জন্য শাড়ী কিনিতাম
নকশী থাকিত তাতে।
শ্রমিক মজুর হতাম যদি
কাজ করিতাম সুখে,
লেখাপড়ার ঝড় তুফানে
মরিতাম না এত দুখে।

Saturday 9 April 2016

কন্যা জায়া জননী

আলী আহমদ চৌধুরী

পৃথিবীর সর্ববহুল উচ্চারিত, সর্বোত্তম শ্রুতিমধুর একটি অক্ষরেই একটি শব্দ, যে শব্দের সাথে অন্য কোনো শব্দের তুলনা হয় না। সে নামটি হল ‘মা’। এ শব্দটি এত শান্তির যে নিজের মনের অজান্তেই উচ্চারিত হয় ‘মা’। সকল দুঃখ কষ্ট লাঘব করে দেয় এ শব্দটি। সব  ধর্মেরই এ ‘মা’ শব্দটকে সম্মান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই শব্দটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ডাকা হলেও বেশিরভাগ ভাষাতেই মাকে সবাই ‘মা’ ধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়েই ডাকে। মায়ের ভালবাসাকে দেশ ও জাতির বিভাজনে পৃথক করা যায় না ঠিক তেমনি বোধহয় ‘মা’ ডাককেও কেউ আলাদা করতে পারেনি। তাই মধুরতম ‘মা’ শব্দটি ভালবাসার মতো সব ভাষাতেই ছড়িয়ে গেছে ‘ম’ ধ্বনি দিয়ে।  
                                                               www.facebook.com/alichowdhury96

এখানে কয়েকটি ভাষায় ‘মা’ শব্দটি তুলে ধরছি। বাংলা-মা, ইংরেজি- মম/মাম্মি/মাদার, আরবী- উম্মি, উর্দু-আম্মি, হিন্দি-মা, ফ্রেন্স মেরে, জার্মানি-ম্রুটার, ইতালিয়ান- মাদ্রে, পর্তুগিজ-মায়ে, আরবেনিয়ান-মেমে, বেলারুশান- মাটকা, সার্বিয়ান-মাজকা, ডাচ মেয়েডেরে-মোয়ের, ক্রিশ্চিয়ান- এমো, গ্রিক-মানা, হাওয়াইয়ান- মাকুয়াহাইন, ক্রোয়েশিয়া মাতি/ মাজকা, ড্যানিশ-মোর, আইসল্যান্ড- মোয়ির, আইরিশ-মাতাইর, নরওয়েজিয়ান-মাদার, পোলিশ- মামা/মাটকা, পাঞ্জাবি-মাই/ মাইকা, রাশিয়ান-মাত, তেলেগু- আম্মা, সিন্ধি-উম্মা, ব্যাবিলন-উম্ম, আক্কাদিয়ান-উম্মি, ইউক্রেনিয়ান- মাতি, বসনিয়ান-মাজকা, ফরাসী- মেরি/মামা, প্রাচীন গ্রিক-মাতির, পারসিয়ান-মাদর/মামো। উপরোক্ত শব্দাবলীর দিকে লক্ষ করলে আমরা বুঝতে পারি য, যেকোনো ভাষা হোক না কেন মায়ের ভালবাসার মতো ‘ম’ ধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মাকে ডাকা হয় প্রত্যেকটি ভাষায়।

নানা বয়সে নানারূপে মা : মমত্ববোধ মেয়েদের স্বভাবজাত। জন্মের পরই মেয়ে সন্তান যেন ‘মা’ হয়ে যায়। মা- বাবা, আত্মীয় স্বজনরা তাকে ‘মা’ বলেই ডাকে। ছোটবেলা থেকেই তার ভিতর মায়ের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। একজন মেয়ে জন্মের পর থেকে মৃত্যু অবধি তিনটি রূপ ধারণ করে থাকেন। প্রথমে বাবার ঘরের কন্যা, দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বামীর ঘরের জায়া এবং সর্বশেষে সন্তানের জন্য পরম আত্মীয় জননী। যিনি পরম শ্রদ্ধেয় একজন।
কন্যা :  একটি মেয়ের তিনটি স্তরের মধ্যে প্রথম ধাপ বা স্তর হচ্ছে বাবার ঘরের কন্যা। তার জীবনের তিনটি স্তরের মধ্যে এ স্তরটি হচ্ছে সবচেয়ে সুখের। বাবার ঘরে থাকে বিধায় এ স্তরটি স্বভাবতই  সুখের হয়ে থাকে। যখন একটি মেয়ের জন্ম হয়, জন্ম হয় যেন একটি মায়ের। শিশুকাল থেকেই তার ভিতর মায়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে এবং তার আচরণেও তা লক্ষ্য করা যায়। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন আদর করে তাকে ‘মা’ বলেই ডাকে। মেয়ে সন্তানেরা যখন ছোট বেলায় খেলাধুলা করে তখন দেখা যায় কেউ কেউ মা-মেয়ে খেলে, কেউ আবার রান্নাবান্না খেলে আর পুতুল খেলা সব ছোট মেয়েরাই খুব পছন্দ করে। মাতৃত্ববোধ থেকেই তাদের মধ্যে এ ধরণের খেলার আবেগ জাগ্রত হয়। আবার আরো একটু বড় হলে মেয়েরা মা-বাবার সেবা করে থাকে, ভাই-বোনদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এভাবেই অবচেতন মনেই ছোট্ট মেয়ের মধ্যেই শিশুকাল থেকেই মায়ের ছবি লক্ষ্য করা যায়। এরপর আসে কিশোর। এ বয়সে মেয়েরা লেখা-পড়ার পাশাপাশি ভালো গৃহিণী, ভালো মা হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করে প্রতিটি পদে। রান্না করা, খাবার পরিবেশন করা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা এসব কাজে মেয়েরা মায়েদের সাহায্য করে থাকে। বিশেষ করে এ সময় কন্যা সন্তানেরা মাকে অনুসরণ করে থাকে। এভাবেই তার প্রশিক্ষণ চলতে থাকে বাবার ঘরে। এক সময় সুখের সময় ফুরিয়ে আসে তার। চলে যেতে হয় স্বামীর ঘরে। শুরু হয় তার জীবনের আরেকটি ধাপ। স্বামীর ঘরের জায়া।
জায়া: জায়া শব্দের অর্থ হচ্ছে ভার্যা, প্নী, বউ, স্ত্রী, বধু ইত্যাদি। স্বামীর ঘরের জায়া হচ্ছে একটি মেয়ের জীবনের তিনটি ধাপের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপ। অন্য এক নতুন জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। আর এই নতুন জীবন বা ধাপটি হচ্ছে স্বামীর ঘরের জায়া। বিয়ের পর একটি মেয়েকে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব তথা ছোটবেলার সকল স্মৃতি পেছনে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে চলতে হয়। সেখানে নিজের করে নিতে হয় শ্বশুর- শাশুড়ি, ননদ-দেবর ও শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়-স্বজনসহ সেখানকার ঘরবাড়ি, কাজকর্ম সমূহ। একটি মেয়ে জীবনে মা- বাবা ছেড়ে আসা অন্যদিকে নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানো এটা এক কঠিন পরীক্ষা। শ্বাশুড়ি চায় বউয়ের হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে দীর্ঘদিনের কর্মজীবনের পর কিছুটা বিশ্রাম নিতে। এভাবে পরিবারের সবাই চায় বাড়ির, নতুন গৃহিণীর সেবা পেতে। সে সেবা যেন হয় মমতাময়ী মায়ের মতো। এই ‘মা’ হতে একটি মেয়েকে ভদ্র, নম্র, উদার ও ধৈর্যশীল হতে হয়। বিবাহ পরবর্তী এ রূপটি একটি মেয়ের জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্টের সময়। বিশেষত গর্ভকালীন সময় তার জন্য বড়র কষ্টের সময়। তাই সবার উচিৎ এ সময়  একটি মেয়ের প্রতি অত্যাধিক যত্নশীল ও সহানুভূতিশীল হওয়া। এ সময় সঠিকভাবে যত্ন  নিলে একজন সুস্থ মা ও শিশু পাওয়া সম্ভব। নতুবা অকালে ঝরে যেতে পারে একটি জীবন তথা একজন ‘মা’।
 জননী : মেয়েরা সব সময়ই ভিন্নরূপী ‘মা’। তারপরও মায়ের একটা বাস্তব রূপ আছে। তাহলো দশমাস দশদিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে জন্ম দানের মাধ্যমে সন্তানের জননী হওয়া। এ সময় ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ কল্পনাও করতে পারে না। এ সময় নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তখন জীবন ও মরণের মধ্যে হাড্ডা- হাড্ডি লড়াই চলে। এত কষ্টের মধ্যেও মায়ের মন খুশীতে ভরপুর থাকে যে, সে সন্তানের ‘মা’ হবে। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে প্রথম যখন সে ‘মা’ হয়, তখনই তার মধ্যে একটি পরিপূর্ণ মায়ের ছবি ফুটে ওঠে।
‘মা’ এবং দু’টি কথা
: ক’দিন ধরে ভীষণ শীত পড়েছে। শৈত্য প্রবাহ এমন দারুণভাবে বইছে যে হিমেল হাওয়া আর ঘন নিবিড় কুয়াশা বাংলার পথঘাট আর গ্রামগুলোকে গ্রাস করে ফেলেছে। বাইরে বের হওয়ার জো নেই। আলোর আর এক নাম জীবন। কথাটা যেন মর্মে মর্মে অনুভূত হচ্ছে। মাঘের শেষের আলো ঝলো- মলো দিনগুলি যেভাবে বসন্তের আগমনী বার্তা বয়ে আনে, তা যেন আজ কথার কথা হতে বসেছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাবে পরিবেশ দূষণ, তদুপরি শ্যালো আর ডিপ টিউবওয়েলের মহিমায় বাংলার ভূ- ভাগ অসময়ে যেভাবে সয়লাব হচ্ছে, তাতে মাঘ থেকে বৈশাখ পর্যন্ত বাংলার পরিবেশ কুয়াচ্ছন্ন থাকতে পারে। এমনি এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কুয়াশা আর শৈত্য প্রবাহের বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে চলেছি বাই- সাইকেলে। কবজি হতে হাতের অগ্রভাগ যেন নিঃষ্প্রাণ হয়ে গেছে। রাস্তার দু’ধারের ছোট ছোট ঘরগুলি সারা রাতের হিম কুয়াশার ভারে বিবশ অচেতন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। ঘন কুয়াশার চাপে দশগজ দূরে কী আছে অনুমান করা যায় না। ছোট্ট একটা বাড়ির নিকটস্থ হয়ে দেখলাম একটি গাভী খুটিতে বাধা। গাভীটি তার শিশু বাছুরকে দুধ দিচ্ছে। গাভীটির শরীরে কোনো শীতাবরণ নেই। শীতের তাড়নায় সে ঠক ঠক করে কাপছে। তবুও সে তার সমস্ত আদর আর আগ্রহ দিয়ে তার বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে। ‘মা’ তার শিশুকে ভালবাসে কথাটা অতি সাধারণ তবু আমার কাছে তা বিশেষ হয়ে ধরা দিল। শীতের হিম ঝাপটা ‘মা’ গাভীর শরীরটাকে দুমড়ে দিলেও সন্তানের প্রতি স্নেহের স্বতঃস্ফূর্ততা তাকে ঝিমিয়ে দিতে পারেনি। তাই মা তার একান্ত মমতা দিয়ে তার শিশুকে জিহ্বা দ্বারা স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আর শিশু বাছুরটি লেজ উচিয়ে মাথা নেড়ে চুক চুক করে মাতৃসুধা নি:সরণ করে নিচ্ছে। মনে হলো ‘মা’ তার সবকিছু দিয়ে তার সন্তানের শান্তি বিধান করতে চায়।  আর তার এ স্নেহের প্রতিদান দেবার মত পৃথিবীতে কোনো কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। তার এস্নেহের কাছে পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকুলতা পরাভূত। মুহূর্তে আমার  ভাবনায় এসে ভীড় জমালো আমার মায়ের কথা। একটি চতুষ্পদ জন্তু সে তার নিজের জীবনকে বাজী রাখে তার সন্তানের মঙ্গলের জন্য। আর ‘মা’ তাদের চেয়ে উর্ধ্বে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের ‘মা’ যখন প্রসবের চরম যাতনার মাঝে সদ্যজাত সন্তানের মুখ দেখে তখন সমস্ত দুঃখ ভুলে যায়। ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানকে সকল প্রতিকুল আবহাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ‘মা’ তার সকল শক্তি প্রয়োগ করে থাকেন। সন্তানের যতেœর ত্রুটি যেন না হয় সে জন্য ‘মা’ সারা রাত জেগে কাটান। শীতের রাতে সন্তান শুকনো জায়গাটি আবার ভিজিয়ে ফেলে তখন ‘মা’ তার সন্তানকে নিজের বুকের ওপর তুলে নেন। এবং সারা রাত জেগে থাকেন যাতে তার সন্তানের কোনো কষ্ট না হয়। সন্তানের অসুখ হলে ‘মা’ সারা রাত তার শিয়রে বসে জেগে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায় যে, ‘মা’ খেতে বসেছেন কিন্তু সন্তান কান্না শুরু করে দিয়েছে ‘মা’ না খেয়ে ওঠে পড়েন এবং সন্তানকে কোলে তুলে নেন। সন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকেই ‘মা’ এসব কিছু যত্নের  সাথে করে থাকেন। সন্তান যখন আরেকটু বড় হয় হামাগুড়ি দেয়, হাঁটতে শেখে তখন তার প্রতি সর্বক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। যেন পড়ে গিয়ে ব্যাথা না পায়। সংসারের নানা কাজের মধ্যেও সন্তানের যত্নের  এতটুকু অবহেলা ‘মা’ করেন না।
সন্তানের প্রথম শিক্ষক
: সন্তানের শারীরিক ও মানসিক গঠনে ‘মা’ অবিচল ভূমিকা পালন করেন। শিশু সন্তান মায়ের কাছ থেকেই চলাফেরা, আদব- কায়দা প্রভৃতি শেখে। ‘মা’ যা করেন তারা তার অনুকরণ করে। মায়ের কাছেই সন্তানের হাতেখড়ি। ‘মা’-ই সন্তানের প্রথম শিক্ষক। ‘মা’ যদি শিক্ষিত হন তাহলে তার সন্তান ছোট অবস্থা থেকেই শিক্ষিত হওয়ার মন মানসিকতা নিয়ে বড় হয়ে থাকে। তাইতো দার্শনিক নেপোলিয়ান বলেছিলেন- "Give me an educated mother I will give you a educated nation" ‘তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ সন্তান যখন স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় ভর্তি হয় তখনও মাকে তার প্রতি বেশি খেয়াল রাখতে হয়। বর্তমান মায়েরা তো সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি আরো অধিক যত্নশীল। সন্তানকে স্কুলে দেয়া- নেয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনা করানো সবই তারা করে থাকেন। সন্তানের কখন কি প্রয়োজন হয় সে দিকেও ‘মা’ খেয়াল রাখেন। মায়ের এই যে পরিশ্রম সবই সন্তানের মঙ্গল কামনায়। সন্তান যেন ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে, যাতে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে, তার জন্য মায়ের চিন্তার অন্ত থাকে না। সন্তান যতদিন পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত না হয় ততদিন পর্যন্ত মায়ের চিন্তা ও প্রচেষ্টার শেষ থাকে না। জীবন
সায়াহ্নে ‘মা’
: সন্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে সংসার শুরু করে ‘মা’ তখন কিছুটা স্বস্তি পান। তিনি সংসারের চাবি তুলে দেন অন্য মায়ের হাতে। প্রধান ভূমিকায় ছেলের বউকে দিয়ে তিনি থাকেন পার্শ্ব ভূমিকায়। সন্তানের সংসার জীবনেও ‘মা’ চেষ্টা করেন তার সুখী সংসার গড়ে দিতে। সন্তানের সুখে ‘মা’ সুখী হন। সন্তান যত বড়ই হোক, তার অভিমান আর অবহেলার গুণিতক যতই বিশাল হোক মায়ের স্নেহের দরজাটা সব সময়ই খোলা থাকে তার সন্তানের জন্য। এই গর্ভধারিনী ‘মা’ সারা জীবন সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে করতে এক সময় বৃদ্ধ হয়ে যান। তার শরীরে আগের মত আর শক্তি সামর্থ্য থাকে না। তখন তিনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ সময় সন্তানই যেন হয় তার একমাত্র ভরসা। বিচিত্র ধরণীতে এমন কত সন্তানকে দেখি যারা তাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের নিয়ে ভুড়ি ভোজ করে নিরাপদে রাতে ঘুমায়। অথচ পাশের ঘরে দুঃখিনী ‘মা’ অনাহারে বিনিদ্রিত রাত্রি গুজরায়। দুঃখ, হতাশা, লজ্জা আর বঞ্চনা যেন সুখে থাকে, ওকে যেন রোগ-শোক না ধরে, তা হলেই মা সুখী। কত ‘মা’র সন্তান বিদেশ বিভুয়ে কালাতিপাত করে। জানি না তারা মাকে কতটুকু মনে রাখে। প্রতিদিনের প্রতি মুহুর্তে শত কাজের মধ্যেও ‘মা’ তাকে আদৌ ভুলেন না। একটু ভালো খাবার হলে ‘মা’ ওর জন্য আলাদা করে রাখে। খাবার নষ্ট হয়ে গেলে অপচয়ের অভিযোগে গৃহস্বামীর বকুনি শোনে। খোড়া অজুহাতে পাশ কাটাতে চায়। বলে ‘ভুলে অমনটা হয়েছে’। সুদূর প্রবাসে চাকরিরত বা অন্য কাজে নিয়োজিত সন্তান যখন বন্ধু- বান্ধব পরিমন্ডলে পরমানন্দে চা- নাস্তার টেবিলে প্রজাপতির রঙ্গিন পাখায় ভর করে মুহুর্ত গোয়ায়, তখন ‘মা’ তার ছোট্ট কালের গ্রামের ছোট্ট বাড়িতে রোগ ব্যাধিকে বুকে বয়ে কালি কাছাড় কলেবরে তার ছেলের কথা ভেবে মনে প্রশান্তি লাভ করে। মার বুকের ধুক ধুকিতে যেন সন্তানের ধ্যান স্পন্দিত হয়। ঘরে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো সন্তানের রেখে যাওয়া পুরাতন জামা কিংবা তার রেখে যাওয়া ছেড়া জুতো জোড়া ‘মা’ সযত্নে এবং সাদরে ঝেড়ে মুছে রাখে। এগুলো যেন তার বেঁচে থাকার সামগ্রী। গভীর রাতে ঘুম থেকে আচমকা জাগরণ মাকে তাঁর সন্তানের কথা দারুণভাবে মনে করিয়ে দেয়। ‘মা’র কানে যেন সন্তানের পদধ্বনি বাজে। মনে হয় ও আসবে ও আসছে। তাই এ সময় সন্তানকে খেয়াল রাখতে হবে যে ‘মা’ দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে জন্মদান করেছেন, শিশুকাল থেকে সেবাযত্ন দিয়ে সন্তানকে বড় করেছেন, সমাজের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলেছেন, সন্তানের সুখের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন তার সর্বস্ব, সন্তানকে বাদ দিয়ে নিজের সুখের কথা ভাবেননি। কোনো দিন সেই মায়ের যেন অবহেলা না হয়। ‘মা’ যদি তার সব স্নেহ ভালবাসা এক কলমের খোচায় লেখা যেত তবে ‘মা’ মমতা নিঃস্বার্থ এসবের সংজ্ঞাও পাল্টে যেত। ‘মা’ কথাটি ছোট্ট হলেও এর আবেদন ব্যাপক ও গভীর। যেন বিন্দুতে সিন্দু। ‘মা’ আছে বলেই মাতৃরূপী এই ধরণী স্নেহমায়া মমতার ফলগু ধারায় স্নাত হয়ে শ্যাম সুন্দর রূপ ধারন করেছে। সৃষ্টিকুল নিয়েই এই চলমান পৃথিবী, আর সৃষ্ট কুলকে লালন করছে মাতৃকুল। মায়েদের স্নেহ পরায়ণতার ঋণ আমরা কখনও শোধ করতে পারব না। বাস্তবে তাই দেবতাকে নয়, দেবীকে ‘মা’, জন্মভূমিকে জনক নয় জননী বলে ডাকি। তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ আমার গর্ভধারিণী ‘মা’। জগতের এই সৃষ্টি প্রবাহে ‘মা’ ও সন্তানের মধ্যে ভালোবাসা কমবেশি লক্ষ্য করা যায়। ‘মা’ ও সন্তানের এ ভালোবাসার কোন মূল্য নিরূপণ করা যায় না। বাস্তব জীবনের সবকিছু এ ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ। তাই বোধ করি সুবোধ বালক বায়েজিদ সারারাত জেগে জেগে পানির গ্লাস হাতে অসুস্থ মার শিয়রে দাঁড়িয়েছিল। বালক বিদ্যাসাগর চাকরী ইস্তফা দিয়ে দামোদর নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল ‘মা’র ডাকে সাড়া দিয়ে। এ জগতে যা যত মূল্যবান তা ততই দুর্লভ বটে। তাই দেখা যায় সৃষ্টির সেরা এই মানবকুলের মধ্যে রয়েছে অনেক দুর্ভাগা সন্তান। ‘মা’র অকৃত্রিম স্নেহ আর দুর্লভ ভালোবাসা ওদের ভাগ্যে বুঝি সয় না। তাই ওরা মাকে দুঃখ দেয়, মাকে কাঁদায়। যারা মাকে সন্তুষ্ট করতে জানে না, যে সব সন্তানের দ্বারা ‘মা’ লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়, তাদের পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নেই। ওরা পাপিষ্ট, নরাধম, ওরা ক্ষমার অযোগ্য। পরিশেষে আমাদের উচিত ইউরোপীয়ানদের মতো আমরা যেন আমাদের মাকে ওল্ডহোমে ফেলে না রাখি। আমাদের সোনার সুখের সংসারে মায়ের যেন ঠাই হয়। ‘মা’ যেন থাকেন সেই সংসারের মধ্যমণি। স্ত্রী-সন্তানের মতো ‘মা’ও যেন সুখের অংশীদার হন। এ কথাই ভাবতে হবে সর্বাগ্রে। কারণ এই মা-ই ছিলেন একসময় বাবার ঘরের কন্যা, স্বামীর ঘরের জায়া, আর সর্বশেষ সন্তানের জননী, যিনি পরম শ্রদ্ধেয় একজন।